ব্যাংক ক্লোজিং ব্যাংকারদের টার্গেট পূরণের দৌড় প্রতিযোগিতা
মুহাম্মদ শামসুজ্জামানঃ ব্যাংকগুলো আর ক’দিন বাদেই তাদের বছর শেষ ক্লোজিং করবে আশাকরি। আগেই অনুমান করে বলছি-এবারেও ব্যাংকগুলোর মুনাফার বড় উল্লম্ফন হবে। ইতিমধ্যেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংকের আয় বা সুদকে আয় হিসেবে দেখাতে বিশেষ সুবিধা দিয়েছে। নতুন নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকগুলো কোনো গ্রাহকের কাছ থেকে ২০২১ সালে যে আয় বা সুদ আদায়ের লক্ষ্য ঠিক করেছে তার ২৫ শতাংশ যদি আদায় করতে পারে তাহলে ওই গ্রাহকের কাছ থেকে আয় বা সুদ বাবদ পাওয়া অথের পুরোটাকে আয় হিসেবে দেখাতে পারবে। এতে ব্যাংকগুলোর মুনাফা বাড়বে। ইসলামী ব্যাংকগুলোও এই নিয়ম অনুসরন করবে।
আরেকটি বড় ধরনের পরিবর্তন হবে মনে করছি, দীর্ঘদিনের জমে থাকা মন্দ ঋণ অবলোপনের ক্ষেত্রে। বর্তমান নিয়ম অনুযায়ী পাঁচ বছরের পরিবর্তে তিন বছর পর্যন্ত বি এল থাকলে, মামলা হয়ে থাকলে এবং একশত পারসেন্ট প্রভিশান করা হলে অবলোপন করা যাবে। ব্যাংকগুলো প্রত্যেক বছর শেষে এরকম মন্দ ঋণ খাতা থেকে বাদ দিবার সুযোগ নেয়। তবে যেসব ঋণ হিসাবে প্রভিশান ঘাটতি আছে সেখানে নতুন প্রভিশান লাগে। একইভাবে যদি উপরে বর্ণিত ২৫% ঋণ আদায়ের ফলে মুনাফা আয় খাতে স্থানান্তরের সূযোগ নেয় সেক্ষেত্রে নিয়মিত ঋণ বা বিনিয়োগে ১% এর স্থলে ২% প্রভিশান লাগবে। অতিরিক্ত প্রভিশান ব্যাংকের খরচ এবং অর্জিত গ্রস আয় থেকেই তা রাখতে হয়।
ব্যাংকারগণ সারা বছরই গ্রাহকদের নানারকম সার্ভিস দেন। আশায় থাকেন, শেষবেলা যেন পারফরমেন্স বিচারে সম পর্যায়ের শাখাগুলোর তুলনায় ভালো ফলাফল আনতে পারেন। বছরের শুরুতে গতানুগতিক বাজেটিং করা হয়। হেড অফিসের কেন্দ্রীয় হিসাব বিভাগ জানুয়ারীর মধ্যেই বটম-আপ পদ্ধতিতে শাখাগুলো থেকে সম্ভাব্যতার নিরীখে কয়েকটি মৌলিক প্যারামিটারে তাদের আকাংখিত টার্গেট আহবান করেন। এগুলো-ডিপোজিট, ইনভেস্টম্যান্ট, ফরেন বিজনেস, রেমিট্যান্স, ওভারডিও হ্রাস ও লাভ। কিছু কিছু প্রগ্রেসিভ ব্যাংক আরো ডিটেইলে চায়। এরপর হেড অফিস চূড়ান্ত করে শাখাগুলোকে তা জানিয়ে দেয়। অনেক সময় শাখাগুলো সেপ্টেম্বর প্রান্তিকেই টার্গেট পূর্ণ করতে সমর্থ হয়, তখন পুনরায় রিভাইসড টার্গেট দেয়া হয়।
টার্গেট পূরণে শাখাগুলো নিজস্ব স্টাইল ও কর্ম পরিকল্পনা গ্রহন করে, কর্মীদের মধ্য তা বন্টন করে এবং মাসিক ভিত্তিতে তা রিভিউ ও এডজাস্ট করে। প্রতিবেশী ব্যাংকগুলোর ডাটা সংগ্রহ করে তা পর্যালাচনা করে। স্থানীয় এলাকার খুবই গুরুত্বপূর্ণ সম্ভাব্য গ্রাহক এখনো ব্যাংক যাকে পায়নি, তাদের সাথে নিজেকে আবার পরিচয় করিয়ে দেয়। বিদ্যমান গ্রাহকদের ব্যবসায়িক চাহিদার পুণর্মূল্যায়ন করে এবং তাদের বর্ধিত বিনিয়োগ সুপারিশ করে। বাড়তি বিনিয়োগ মানে বাড়তি ডিপোজিট সংগ্রহ।সুতরাং সেটার তালাশিও সমান প্রয়োজনীয় তবে সতর্ক হতে হবে যেন সেটা লার্জলি কম খরচের হয়। সম্প্রতি ব্যাংকগুলো শুন্য খরচের দিকে মনোযোগী। সেক্ষেত্রে সরকারী বিল, পেমেন্ট, চালান এগুলো খুঁজতে হবে এবং বড় কর্পোরেট হাউজগুলোর কাছে ধর্না দিতে হবে। বারগেইন করতে গিয়ে বেশি খরচে বড় ডিপোজিট হান্টিং বিপজ্জনক কারণ যে কোন সময় তা উঠে যেতে পারে।
ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন। |
আয় বেশী করে বেশী লাভ করার কৌশল এখন তেমন কাজ দেয়না বরং কম খরচ করে বা খরচে সাশ্রয়ী হয়ে লাভ বেশী করার লক্ষ্য থাকা উচিত। বেসরকারী ব্যাংকগুলোর এটাই বিপদ। অধিক সাজসজ্জা, বৃহদায়তনের স্পেস হায়ারিং এবং অপারেশনাল খরচ তুলনামূলক বেশী। আমানতের উপর মুনাফা সব সময় বাজার প্রতিযোগীতামূলক। কাজেই ব্যাংকগুলো এখানে হাত দিতে চায়না কারণ তা আত্মহত্যার শামিল। তবে কৌশল করে নানা ধরনের নিয়মের আবর্তে মুনাফার যৌক্তিকীকরণ করে। ইসলামী ব্যাংকগুলো ডিসেম্বরে প্রভিশানাল মুনাফা প্রয়োগ করে যা পরবর্তীতে হিসাব চূড়ান্তকরণে আবার এডজাস্ট করা হয়। ব্যাংকের সবচেয়ে বড় দুষ্টক্ষত হলো মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ বা মন্দ ঋণ। এটা শুধু ব্যাংককে লাভ বঞ্চিতই করেনা উপরন্ত কষ্টের উপার্জনও খেয়ে ফেলে। তাই বছর শেষে যে কোন চেষ্টার বিনিময়ে বিনিয়োগকে পারফর্মিং রাখা শাখাগুলোর বাড়তি দায়িত্ব।
অনেক ব্যবস্থাপককে দেখেছি, হেড অফিসের টার্গেটকে মোটেও ভয় পাননা, আবার কেউ তো এটাকে কমাতে যেন ঢাল তলোয়ার নিয়ে বাকযুদ্ধে নামেন। এরা প্রতিষ্ঠান নিয়ে ভাবেন কম, বিনিয়োগ দিতেই চান না, হেড অফিসে ফান্ড খাটিয়ে যে সামান্য আয় হয় তাতেই সন্তষ্ট থাকেন। এগুলো এক ধরনের ঝুঁকিবিহীন কসরৎ, এতে ব্যাংকের কোন উন্নতি হয়না, নিজেরও না। আপনার বিদ্যমান ক্লায়েন্টদের সাথেই শুরু করুন, তাদের সাথে ব্যবসায়িক মিটিং এবং পরিদর্শনের ব্যবস্থা করুন, তারা আপনাকেও জানে এবং ব্যাংককেও জানে। প্রতি বছরই এভারেজ ৩০% প্রবৃদ্ধি সবারই হয়। আপনাকে কেবল ব্যাংকের সাথে তাদের সম্পর্কোন্নয়ন ঘটালেই ঐটুকু টার্গেট অর্জন করা সম্ভব। সমস্যা নতুন ডিপোজিট ও ব্যবসায় না বরং সবচেয়ে কঠিন হলো ওভারডিও ঠেকানো এবং সেটা বিগত বছর থেকেও কমিয়ে আনা।
আমার অভিজ্ঞতায়, মেয়াদ উত্তীর্ণ বিনিয়োগের প্রধানতম কারণ হলো উপযুক্ত তদারকির অভাব। ব্যাংকগুলো ডিল ডিসবার্সমেন্টের জন্য যত আগ্রহী ও তৎপরতা দেখায় বিনিয়োগ খেলাপী হলে আদায়ের ব্যাপারে তেমন কোন আগ্রহ দেখায় না। টাস্ক ফোর্স, দায়িত্ব ভাগ, মিটিং সবই কাগজে কলমে পাবেন কিন্ত ইফেকটিভ মনিটরিং না রেগুলার থাকাকালীন ছিল আর না ওভারডিউতে আছে। একবার ব্যাংকের টাকা বেরিয়ে গেলে সেটা ঘরে ফিরত আনা অসম্ভব কঠিন যদি ভালো গ্রাহক না হয়। এক বছরের ডিল মানে এক বছর পর তাগাদা দেয়া নয়, প্রতি তিন মাস পর পর বিক্রিত টাকা জমা করার তাগাদা দিন, মাসে একবার ভিজিট করুন, সেল মনিটর করুন, মালের মুভমেন্ট দেখুন। কোন ব্যত্যয় চোখে পড়লে পরের ডিলে সতর্ক হোন। যেখানে ম্যানেজারসহ পূরো টিম তদারকির বিষয়ে তৎপর সেখানে মৃত বিনিয়োগ হার অপেক্ষাকৃত কম ও আদায় অগ্রগতি সন্তোষজনক।
যাহোক, বলছিলাম ক্লোজিং এর কথা। এর আলাদা একটা মজা আছে, কাজ শেষে তৃপ্তি আছে, আছে সারা বছরের হিসাব মিলানো শেষে লাভ জানার আগ্রহ আতিশয্য। শাখার পিওন, প্রহরী থেকে ম্যানেজার সকলের মধ্যেই এক ধরনের স্ফূর্তি ও প্রাণ চাঞ্চল্য কাজ করে পূরো ডিসেম্বর জুড়েই। অবশ্য এখন এই উত্তাপ অনেকটাই প্রশমন করে দিয়েছে ডিজিটাল প্লাটফর্ম। এখন সবকিছু প্রোগ্রামিং করা থাকে। ব্রাঞ্চের পোস্টিং, ব্যালাঞ্চিং কোন কিছুরই ঝামেলা নেই। সব হেড অফিস আইটি নিয়ন্ত্রিত। রাত বিরাত করার প্রয়োজনই হয়না। অথচ আমাদের এসব আয়োজন হাতে কলমে করতে হয়েছে। রাতভর পোস্টিং শেষে আবার লেজারগুলোর ব্যালাঞ্চিং সেকি কষ্টকর অভিজ্ঞতা। এরপর এফেয়ার্স তো চারদিনেও মিলানো যেতোনা। সিনিয়র জুনিয়র সবাই মিলে কস্ট করে ক্লোজিং এর কাজ সামাল দিতে হতো। তবুও সবাই কেমন আনন্দ নিয়ে অন্তর লাগিয়ে কাজগুলো করতো।
ব্যাংকারদের সকলের প্রতি রইলো শুভকামনা। আশা করছি ২০২১ সবারই ভালো ক্লোজিং হবে, সন্তোষজনক মুনাফা হবে।
লেখকঃ মুহাম্মদ শামসুজ্জামান, সাবেক অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি), ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড।