শেয়ার বাজার

অ্যানুয়াল রিপোর্ট বা বার্ষিক প্রতিবেদন

অ্যানুয়াল রিপোর্ট বা বার্ষিক প্রতিবেদন কোম্পানির ব্যবসা ও আয়-ব্যয়ের গুরুত্বপূর্ণ দলিল। স্টেকহোল্ডাররা অতি মনোযোগের সঙ্গে এ প্রতিবেদন পড়েন। বিভিন্ন স্টেকহোল্ডার বিভিন্ন উদ্দেশ্যে এ প্রতিবেদন পড়ে থাকেন। রাজস্ব বোর্ড পড়ে কোম্পানি ট্যাক্স ফাঁকি দিল কিনা, তা জানার জন্য; ব্যাংক পড়ে কোম্পানিকে আরো ঋণ দেয়া যায় কিনা, তা দেখার জন্য। তবে অন্য স্টেকহোল্ডারদের থেকে শেয়ারহোল্ডারদের কাছে বার্ষিক প্রতিবেদনের গুরুত্ব আরো অনেক বেশি। তারা সিদ্ধান্ত নেন কোন নির্দিষ্ট কোম্পানির শেয়ার রাখবেন কি বেচে দেবেন। কিনলে কত টাকা পর্যন্ত কিনবেন। বার্ষিক প্রতিবেদন শেয়ারহোল্ডারদের জন্য তথ্যপ্রাপ্তির বড় ভাণ্ডার, তারা অন্য সূত্র থেকেও তথ্য পান। তবে বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে ঢের বেশি পান। প্রতিবেদনে কয়েকটি অংশ থাকে। এর মধ্যে চেয়ারম্যানস রিপোর্ট ও ডিরেক্টরদের রিপোর্ট থাকা আইনে অত্যাবশ্যক করা হয়েছে। চেয়ারম্যানস রিপোর্ট ও ডিরেক্টরস রিপোর্ট প্রায় একই রকম। কোম্পানি হিসাব বছরে কী করেছে, কী করতে পারেনি, সামনে কী করবে, কীভাবে করবে— এসব ব্যাপারে আশাবাদ এবং দুঃখ বর্ণনা করে কয়েক পৃষ্ঠার বক্তব্য থাকে এতে। তবে অতিগুরুত্বপূর্ণ পরিসংখ্যান শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) কমে গেলে অন্তত চেয়ারম্যান মহোদয় ওই ব্যাপারে একটা ব্যাখ্যা দিতে চেষ্টা করেন।

ইপিএস কমে গেলে শেয়ারহোল্ডারদের মুখ কালো হয়। তবে সব শেয়ারহোল্ডারের মুখ কালো হয় বলে মনে হয় না। বিশেষ করে আমাদের দেশীয় কোম্পানির উদ্যোক্তা শেয়ারহোল্ডারদের মুখ কালো হতে দেখিনি। তারা ইপিএস কমার ব্যাখ্যা হিসেবে অনেক ব্যাখ্যা হাজির করেন, যেগুলোর অধিকাংশই মাইনরিটি শেয়ারহোল্ডারদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয় না। বার্ষিক প্রতিবেদনের দুটো গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো— ব্যালান্সশিট বা স্থিতিপত্র এবং ইনকাম স্টেটমেন্ট বা আয়ের হিসাব। আংকিক সংখ্যায় এ দুটো প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। এবং এ দুটো প্রতিবেদন এজন্যই বেশি গুরুত্বপূর্ণ যে, এই দুটোতে কোম্পানির অ্যাসেট লায়াবিলিটির হিসাব থাকে এবং কোম্পানির ব্যয় বাদ দিয়ে নিট আয়ের একটা হিসাব থাকে। ইনকাম স্টেটমেন্ট পড়লে বোঝা যাবে কোম্পানি ভালো করছে না কি মন্দ করছে। এ স্টেটমেন্টের সঙ্গে অনেক নোটস (Notes to The Accounts) থাকে, যেগুলো আংকিক পরিসংখ্যানগুলোকে ব্যাখ্যা করে। প্রতিবেদনের এ দুটো অংশ সনদপ্রাপ্ত অডিটর সই করেন। অডিটর হলেন স্বাধীন নিরপেক্ষ, তাই শেয়ারহোল্ডাররা নিরপেক্ষতার সার্টিফাইড করা বক্তব্যকে সত্য বলে গ্রহণ করে নেন। তবে অডিটর স্বাধীন ও সনদপ্রাপ্ত হলেও দেখা যায় কর্তব্যে অবহেলা করেছেন এবং মিথ্যা তথ্য ও পরিসংখ্যানকে সার্টিফাই করেছেন। এই নিয়ে বাংলাদেশে সাধারণ শেয়ারহোল্ডাররা অনেক অভিযোগ করেছেন কিন্তু অডিটর সাহেবের সনদ বাতিল হতে দেখা যায়নি। আর মাইনোরিটি শেয়ারহোল্ডারদের অভিযোগই বা কেন করতে হবে। রেগুলেটরের তো স্বপ্রণোদিত হয়ে মিথ্যুক অডিটরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া উচিত ছিল।

অডিটর সাহেবরা যে দেশীয় কোম্পানির ইনকাম স্টেটমেন্ট সার্টিফাই কারার ক্ষেত্রে মিথ্যা সার্টিফাই করছেন তা নয়। তারা বিদেশী কোম্পানির ইনকাম স্টেটমেন্ট সার্টিফাই করতেও কর্তব্যে অবহেলা করছেন। একটা বহুজাতিক কোম্পানি ম্যানেজমেন্ট ফি বাবদ বিদেশী মুদ্রায় বড় অংকের অর্থ বিদেশে নিয়ে গেছে। আমি শেয়ারহোল্ডারদের বার্ষিক সভায় অডিটর সাহেবকে বললাম যে, এ অর্থের সংখ্যা কী? কোথাও তো লেখা নেই, কোন যুক্তিবলে কত দিনের জন্য কোন হারে এ কোম্পানিকে ব্যবস্থাপনা ফি বাবদ এত টাকার অর্থ বিদেশে পাঠাতে হবে। অডিটর সাহেব আমার কথার ভালো উত্তর দিতে পারলেন না। আমি মনে করি, এটা অডিটরেরই দায়িত্ব ছিল এ অর্থ বিদেশে নেয়ার ক্ষেত্রে একটা ভালো ব্যাখ্যা দেয়া। এখন অডিটর যদি ম্যানেজমেন্ট যা সরবরাহ করে, তা সই করার জন্য এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকেন তাহলে শেয়ারহোল্ডাররা কোনো দিনই একটি ভালো বা সঠিক প্রতিবেদন পাবেন না। আশা করি, নবগঠিত ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিল (এফআরসি) অডিটরদের কর্তব্যে ব্যর্থতার ক্ষেত্রগুলোয় বড় রকমের শাস্তির ব্যবস্থা করবে।

আর আমাদেরও উচিত হবে অডিটরদের ব্যাপারে অভিযোগগুলো এফআরসির নজরে নেয়া। বাংলাদেশের লোকেরা অসত্য ও অন্যায়কে নীরবে হজম করে। তারা যেখানে অভিযোগ দায়ের করা দরকার সেখানে করে না। তবে শেয়ারহোল্ডাররা অভিযোগ দায়ের করবেন কী, তারা তো শেয়ারহোল্ডারদের বার্ষিক মিটিংয়ে (এজিএম) যান না। অতি নগণ্যসংখ্যক শেয়ারহোল্ডার এজিএমগুলোয় যান। তাও এদের মধ্যে অধিকাংশই যান দলবেঁধে আলোচনার আগে এজিএমের এজেন্ডাগুলোকে পাস করিয়ে দেয়ার জন্য। সংবাদ মাধ্যম খবর দিয়েছে, একটা ব্যাংকের এজিএম শেষ হয়ে গেছে মাত্র ৭ মিনিটে। অথচ এ সংবাদ রেগুলেটর পড়েছেন। কিন্তু কেন শেষ হলো, কীভাবে শেষ হলো, রেগুলেটর এ ব্যাপারে ব্যাখ্যা চাওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি। কোম্পানিগুলো যে দালাল পার্টি ভাড়া করছে, এজন্য কী করা যায়, সেটা দেখার দায়িত্ব তো রেগুলেটরের।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

সারা বিশ্বে এজিএম চলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এমন ঘটনাও ঘটে যে, শেয়ারহোল্ডারদের অভিযোগের কারণে কোম্পানির চেয়ারম্যান-সিইও পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। আর আমাদের এখানে ৭ মিনিটে এজিএম শেষ! এ দোষ শেয়ারহোল্ডারদেরও। তারা কেন এজিএমগুলোয় যান না? শুধু নাশতার প্যাকেট বন্ধ হয়ে গেছে বলে তাদের এই উপস্থিতির আকাল! ওই ইস্যুয়ার শেয়ারহোল্ডাররা নাইবা গেলেন, কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক শেয়ারহোল্ডারদের প্রতিনিধির তো অন্তত যাওয়া উচিত ছিল। তারাই তো জনগণের শত শত কোটি টাকা কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করছেন। জুতো কোথায় পা কাটে, তাদের তো জানার কথা। এমনকি তারা একত্র হলে শেয়ারহোল্ডারস ডিরেক্টরস হতে পারতেন। অন্য বিষয় হলো, কোম্পানি আজকাল অ্যানুয়াল রিপোর্ট বা বার্ষিক প্রতিবেদন শেয়ারহোল্ডারদের কাছে পাঠায় না। কয়েক কপি তারা হয়তো ছাপায়। কিন্তু ওইসব প্রতিবেদন এবং এজিএমে উপস্থিত হওয়ার জন্য দাওয়াতপত্র কোম্পানি এখন আর পাঠায় না। কোম্পানি ধরেই নিয়েছে কোনো শেয়ারহোল্ডার এজিএমে আসবেন না। সুতরাং অর্থ ব্যয় করে প্রতিবেদন পাঠিয়ে লাভ কী! কিন্তু এটা ভালো যুক্তি নয়।

শেয়ারহোল্ডার না এলেও তিনি বাড়িতে বসে ওই প্রতিবেদন পড়তে পারেন। বার্ষিক প্রতিবেদন পাওয়া শেয়ারহোল্ডারদের অধিকার। এ অধিকার থেকে যে শেয়ারহোল্ডারদের বঞ্চিত করা হচ্ছে, সেটা কি বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) দেখছে না? আমি এ বছর তিনটি কোম্পানির এজিএমে গিয়েছি। তিনটি কোম্পানির মধ্যে একটি আমার কাছে বার্ষিক প্রতিবেদন পাঠিয়েছে। অন্য দুটো প্রতিবেদন আমাকে তাদের অফিস থেকে সংগ্রহ করতে হয়েছে। কয়েকটা ব্যাংকের শেয়ারও আমি ধারণ করি। শুধু একটা ব্যাংক তাদের প্রতিবেদন পাঠিয়েছে। অন্য একটা ব্যাংকের প্রতিবেদন আমাকে তাদের অফিস থেকে সংগ্রহ করতে হয়েছে। এজিএমের বর্তমান সংকট যত দিন চলবে তত দিনই কোম্পানির ম্যানেজমেন্ট খুশি থাকবে। কারণ তাদের তো জবাবদিহি করতে হচ্ছে না। প্রতিবাদে বা প্রতিরোধে পড়তে হচ্ছে না। তারা স্যুট-টাই পরে মঞ্চে গিয়ে বসছেন, আধা ঘণ্টা বড়জোর ১ ঘণ্টার মধ্যে সভা শেষ হয়ে গেল, ইয়েসম্যানরা হাত তুলে সব এজেন্ডা পাস করিয়ে দিচ্ছেন। এখন আর শেয়ারহোল্ডারদের কাছে কী নিয়ে যাবে এ কোম্পানি, ম্যানেজমেন্ট তা ভাবে না। কারণ কোনো ডিভিডেন্ড না দিলেও ইয়েস বলার জন্য তো কিছু কথিত শেয়ারহোল্ডারকে আগে থেকে প্রস্তুত করাই আছে। এ ধরনের এজিএম থেকে সাধারণ শেয়ারহোল্ডারা কোনো উপকারই পেতে পারেন না এবং পাচ্ছেনও না। কর্তৃপক্ষ কি বিষয়টি দেখবে?

বার্ষিক প্রতিবেদনটি পড়ার জন্য আমি আগ্রহী বিনিয়োগকারীকে অনুরোধ করব। কারণ হলো, ওখানে মিথ্যা তথ্য থাকলেও অনেক তথ্য থাকে, যেগুলো বিনিয়োগকারী অন্যত্র পাবেন না। তথ্য গোপন করলে সেটাও বের করার উপায় আছে। আর সব পরিসংখ্যানই যে বিনিয়োগকারীকে একটা নির্দেশনা দেবে এমন নয়; যা কিছু বার্ষিক প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয় তার একটা ব্যাখ্যা বিনিয়োগকারী নিজে ব্যবহারের জন্য দাঁড় করাতে পারেন। কিছু কথা বলতেই হবে এজন্য যে, ওই সব বলার জন্য রেগুলেটরের নির্দেশ আছে। ব্যাংকিং কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রে তথ্য লুকানোর জায়গা অল্পই। কারণ ব্যাংক কোম্পানির আসল অর্জন নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক অনেক বেশি কঠোর। সুতরাং ব্যাংক কোম্পানি ইচ্ছে করলেও কুঋণকে সুঋণ হিসেবে দেখাতে পারবে না। আমি অল্প বয়সের নতুন বিনিয়োগকারীদের অনুরোধ করব হিসাববিদ্যার কিছু বিষয় বোঝার জন্য। হিসাববিজ্ঞান বা অ্যাকাউন্টিং কোনো কঠিন কিছু নয় যে, জানতে চাইলে জানা যাবে না। অন্তত নিজেদের কাজ চালানোর জন্য এ বিদ্যার যতটা শেখা দরকার ততটা শেখা জরুরি।

লেখক: আবু আহমেদ; অর্থনীতিবিদ ও শেয়ারবাজার বিশ্লেষক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button