খেলাপি ঋণ

অর্থনীতিতে ঝুঁকি বাড়াচ্ছে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ

খেলাপিদের কাছেই জিম্মি হয়ে পড়েছে দেশের ব্যাংকিং খাত। শীর্ষ ১০০ ঋণ খেলাপির কাছে বিভিন্ন ব্যাংকের পাওনা ১ লাখ ১১ হাজার ৩৪৭ কোটি টাকা আটকে রয়েছে। কিছুদিন আগে জাতীয় সংসদে এই তালিকা প্রকাশ করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তালিকার মধ্যে রয়েছেন দুই ব্যক্তি। বাকি সব প্রতিষ্ঠান।

বিশ্লেষকদের অভিমত হলো, খেলাপি ঋণের এই টাকা আর আদায় হবে না। যে কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যাংকগুলোকে বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে পড়তে হবে। ব্যাংকের অন্যতম কাজ হলো দেশের অর্থনীতি ও ব্যবসা চাকা সচল রাখতে ঋণ দেওয়া এবং সময়মত সে ঋণ আদায় করা। ব্যাংকের প্রধান সম্পদই হলো এ ঋণ। যে কোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে শক্তিশালী ব্যাংকিং ব্যবস্থা অপরিহার্য।

বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে ব্যাংক ও আর্থিক খাতে অনিয়ম রেখে সুষম উন্নয়ন ও উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব নয়। কাজেই এ খাতে আমূল সংস্কার এখন সময়ের দাবি।

শীর্ষ ১০০ ঋণ খেলাপির তালিকাটি নিয়ে নানা প্রশ্নের অবকাশ থাকলেও এ ধরনের তালিকা প্রকাশ ব্যাংকগুলোকে খেলাপি ঋণ আদায়ে এবং ঋণ গ্রহীতাদের খেলাপি না হতে উত্সাহিত করতে পারে। শীর্ষ ১০০ ঋণ খেলাপির যে তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে তার বেশিরভাগই সরকারি ব্যাংকের গ্রাহক। বছরের পর বছর চলতে থাকা অনিয়ম ও দুর্নীতি ঋণ বিতরণে রাজনৈতিক প্রভাব, সুশাসনের অভাব, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ কম থাকাসহ নানা কারণে এসব ব্যাংক ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়েছে। ঋণ খেলাপিদের মধ্যে বেশকিছু প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা একাধিক সরকারি ব্যাংকে খেলাপি। কয়েকটি প্রতিষ্ঠান সরকারি ব্যাংকের পাশাপাশি বেসরকারি ব্যাংকেও খেলাপি। অর্থমন্ত্রী যে তালিকা দিয়েছেন তারা বর্তমানে কাগজে কলমে খেলাপি। কিন্তু আরো অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা ঋণ পুন:তফসিল ও পুনর্গঠন এবং আদালতে রিট করে খেলাপির তালিকার বাইরে রয়েছেন। এছাড়া ব্যাংকগুলো অনেক প্রতিষ্ঠানের ঋণ অবলোপন করে হিসাবের খাতার বাইরে রেখেছে। এগুলোকে যদি হিসাবে ধরা হয় তাহলে খেলাপি ঋণের চিত্র আরও ভয়াবহ হবে।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

সরকারি ব্যাংকগুলো হাজার হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ আদায়ে অসমর্থ হওয়ায় ক্ষোভ-অসন্তোষ বাড়ছে ক্রমেই। ইতোমধ্যেই বিভিন্ন মহল ব্যাংক ঋণ অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের শাস্তি নিশ্চিত করার পাশাপাশি খেলাপি ঋণ আদায়ে পদক্ষেপ গ্রহণ এবং ভবিষ্যতে ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে উপযুক্ত ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠান মূল্যায়ন করার পরামর্শ দিয়েছেন। ব্যাংক খাতে আদায় হবে না এমন মন্দ ঋণের হার বাড়ছেই। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রাজনৈতিক সুবিধায় ঋণ পুনর্গঠন ও বিশেষ সুবিধায় পুনঃতফসিল করার সুযোগ দেওয়ার পরও খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমছে না। প্রতিনিয়ত খেলাপির পরিমাণ বাড়ছে। রাজনৈতিক প্রভাব এবং যাচাই-বাছাই ছাড়াই ঋণ বিতরণের কারণে এটি হচ্ছে। এর সঙ্গে ব্যাংক কর্মকর্তাদের অদক্ষতা ও দুর্নীতিও রয়েছে। ব্যাংকাররা যেমন দুর্নীতির মাধ্যমে ঋণ দিয়েছেন, তেমনি প্রকল্প প্রস্তাব নিয়মমাফিক পরীক্ষা না করেও ঋণ দিয়েছেন। ফলে আদায় অযোগ্য ঋণের পরিমাণ বেড়েই চলেছে।

অর্থমন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, সংসদীয় কমিটি নানা দিক-নির্দেশনা প্রদান করেছেন খেলাপি ঋণের অভিশাপ ঘোচাতে। রাষ্ট্র মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদ, ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ও অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা, পরামর্শ অনুযায়ী তাদের ব্যাংকের খেলাপি ঋণ আদায়ে বিভিন্ন কর্মসূচি, পদক্ষেপ গ্রহণ করছেন। নিয়মিত সভা আয়োজন করে মাঠ পর্যায়ে গৃহীত কার্যপদক্ষেপের ফলাফল মনিটর করছেন। শাখাগুলো খেলাপি ঋণ আদায়ে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।

খেলাপি ঋণ আদায় না হওয়াটা ব্যাংক খাতের জন্য অশনি সংকেত। যাচাই-বাছাই ছাড়াই ঋণ দেওয়ার কারণে এমন চিত্র দেখা যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে ব্যাংক খাতের শৃঙ্খলা ভেঙে পড়বে। সুদের হার ও বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ঋণ আদায় অযোগ্য হয়ে পড়ার পেছনে বড় কারণ রাজনৈতিক বিবেচনায় এবং ব্যাংকের চেয়ারম্যান, পরিচালক ও এমডির যোগসাজশে ঋণ দেওয়া। যোগসাজশে যাচাই-বাছাই ছাড়াই ঋণ দেওয়ার পথ বন্ধ করতে হবে। তা না হলে মন্দ ঋণের পরিমাণ আরো বেড়ে যেতে পারে।

ব্যাংকিং নিউজ বাংলাদেশ (Banking News Bangladesh. A Platform for Bankers Community.) প্রিয় পাঠকঃ ব্যাংকিং বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবরগুলো নিয়মিত আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ ব্যাংকিং নিউজ বাংলাদেশ এ লাইক দিয়ে আমাদের সাথেই থাকুন।

ব্যবসায়ী ও বাণিজ্যিক ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটে ব্যবসা-বাণিজ্যে অনেকটা নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। বেসরকারি বিনিয়োগে অনেকটাই স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে যারা ব্যাংক ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করেছেন, তাদের অনেকেই ঋণ নিয়মিত পরিশোধ করতে পারছেন না। নাম লেখাচ্ছেন ঋণখেলাপির তালিকায়।

মাঝারি পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা সব থেকে খারাপ অবস্থায় রয়েছে। কম পুঁজির এসব ব্যবসায়ীর অনেকে অর্থ অভাবে নতুন করে বিনিয়োগ করতে পারছেন না। ফলে ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের টাকাও নিয়মিত পরিশোধ করতে পারছেন না। যার প্রভাবে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাচ্ছে।

ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী খেলাপি ঋণ বেড়ে গেলে ব্যাংকের সরাসরি মুনাফায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। কারণ খেলাপি ঋণের শ্রেণি ভেদে ব্যাংকগুলোর ২৫ শতাংশ থেকে শতভাগ প্রভিশন রাখতে হয়। এ প্রভিশন রাখতে হয় ব্যাংকের মুনাফা থেকে। এ ছাড়া মন্দ ঋণের বিপরীতে অর্জিত সুদ ব্যাংকগুলো আয় হিসেবে দেখাতে পারে না। এ সুদ স্থগিত করে রাখা হয়।

বিগত কয়েক বছর ধরে ঋণ পুনর্গঠন ও পুনঃতফসিলসহ নানামুখী সুবিধা পেয়েছেন বড় ব্যবসায়ীরা। কিন্তু সুবিধা নেওয়া ব্যবসায়ীরা ঋণের টাকা সময়মত ফেরত দিচ্ছেন না। অথচ যেসব ছোট ব্যবসায়ী পুনর্গঠন ও ঋণ পুনঃতফসিল থেকে বঞ্চিত হয়েছেন, তারাই ঋণের টাকা পরিশোধে এগিয়ে রয়েছেন।

জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী ঋণ খেলাপিদের যে একটি তালিকা প্রকাশ করেছেন। সেটাকে আমরা ইতিবাচক হিসেবে দেখতে চাই। এখন আমরা চাই তালিকা অনুযায়ী এবং তালিকার বাইরে থাকা সব ঋণ খেলাপির বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। আর এ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাটি অবশ্যই হতে হবে খেলাপি ঋণ আদায়ের লক্ষ্যে। রাজনৈতিক বিবেচনায় বা অনিয়ম দুর্নীতি করে ঋণ অবলোপন করার প্রক্রিয়া আমরা আর দেখতে চাই না। ব্যাংকিং কমিশন গঠন, কেন্দ্রীয় ব্যাংককে শক্তিশালীকরণ ব্যাংকগুলোতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করা প্রভৃতি প্রশ্নে সরকারকে জোরালো অবস্থান গ্রহণ করতে হবে। এ বিষয়ে বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক সংগঠনকে দলমত নির্বিশেষে সাহসী, পক্ষপাতহীন, আন্তরিক মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button