ব্যাংক গ্রাহকব্যাংকার

গ্রাহক অসন্তুষ্টির কারণ ও ব্যাংকের করণীয় ২

গ্রাহক সন্তুষ্টির সংজ্ঞা ও মানদণ্ড নিয়েও প্রশ্ন আছে। সকাল দশটা থেকে বিকাল চারটা পর্যন্ত ব্যাংকিং লেনদেনের সময় হলেও, বিকাল পাঁচটার পরও কোনো কোনো গ্রাহক ব্যাংকে টাকা জমা দিতে বা উত্তোলন করতে আসেন। আর যদি ব্যর্থ হন, তাহলে নিজেকে সেবাবঞ্চিত মনে করেন। আবার অন্য কোনো ব্যাংক সেই একই গ্রাহককে বিকাল পাঁচটার পরেও যদি জমা বা উত্তোলন অ্যালাউ করে, সেক্ষেত্রে সেবা ও হয়রানির সংজ্ঞা কোনটা সঠিক? আমাদের ব্যাংকিং প্র্যাকটিস ও অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ব্যাংকারদের সেবার অতিরঞ্জনের কারণেও অন্য ব্যাংকাররা বদনামের ভাগী হন এবং গ্রাহকরা নিজেকে সেবাবঞ্চিত মনে করেন।

যেমন, কিছুদিন আগে স্থানীয় একজন বিশিষ্ট উদ্যোক্তার সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি নিজের ব্যাংক সম্পর্কে বলছিলেন যে, তার ব্যাংকে তার জন্য কোনো চারটা-পাঁচটা নেই, যখনই চান ব্যাংক তার টাকা গ্রহণ করে এবং তার চেকের পেমেন্ট অ্যালাউ করে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যে ব্যাংকটি চারটার পরে কোনো লেনদেন অ্যালাউ করল না, সেটি কি গ্রাহককে হয়রানি করল? আর যে ব্যাংক নিয়মবহির্ভূতভাবে চারটার পরেও গ্রাহকের জমা গ্রহণ করল কিংবা চেকের পেমেন্ট প্রদান করল, সেটি কি তার গ্রাহককে সেবা প্রদান করল? যদি আমি দ্বিতীয় ব্যাংকের সেবার দৃষ্টিভঙ্গি ঠিক বলে ধরি, তাহলে অবশ্যই বলতে হবে আমাদের সেবার মানদণ্ডে পরিবর্তন আনতে হবে। কোনো ব্যাংক চারটার পর লেনদেন অ্যালাউ করলে অন্য ব্যাংক কেন করবে না। কিংবা কোনো ব্যাংক চারটার পর লেনদেন অ্যালাউ না করলে, অন্য ব্যাংকইবা কেন করবে? যদি করতে হয় সবাই করবে, আর না করলে কেউই করতে পারবে না।

ব্যাংকগুলোতে অভিযোগ বাক্সের ব্যবস্থা নেই বলেও বিআইবিএমের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু আমার প্রায় নয় বছরের ব্যাংকিং অভিজ্ঞতায় শাখার অভিযোগ বাক্সে কোনো লিখিত অভিযোগ পড়তে দেখিনি, একবার কয়েকটি ধাতব কয়েন পেয়েছি, হয়তো দানবাক্স মনে করে কেউ দান করেছিলেন। তাছাড়া বর্তমানে ইন্টারনেট জগতে কাগজে লিখিত অভিযোগে কয়জন গ্রাহকেরই বা সময় কিংবা ইচ্ছা আছে। আর বাক্স যদি রাখতেই হয়, তাহলে শুধু অভিযোগ বাক্স কেন? সুপারিশ ও প্রশংসা বাক্সও থাকুক, যাতে গ্রাহকরা বিশেষ কোনো পণ্য বা সেবা বিষয়ে পরামর্শ বা চাহিদা ব্যাংককে জানাতে পারে। অন্যদিকে ব্যাংক কিংবা কোনো বিশেষ ব্যাংকারের সেবায় মুগ্ধ হলে গ্রাহক যাতে প্রশংসা-মন্তব্য লিখে যেতে পারেন, যা পরে কর্মীদের পারফরম্যান্স মূল্যায়নেও কাজে আসবে।

কোনো এক শাখার প্রভাবশালী একজন গ্রাহক একটি অনলাইন পেমেন্ট নিতে একই ব্যাংকের আরেকটি শাখায় চেক প্রেজেন্ট করলেন। কর্মকর্তার সামনে চেয়ারে বসে তিনি ব্যাংকের ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে তার সম্পর্কের গভীরতা বর্ণনা করে নিজের প্রভাব বোঝানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে গ্রাহকের হিসাবধারী শাখার সার্ভার (ব্যাংকে শাখাভিত্তিক সার্ভার ব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল) বিকল থাকায় চেকটি পাস করা যাচ্ছিল না। গ্রাহককে সমস্যার কথা বলে একটু অপেক্ষা করতে বললে, উনি অপেক্ষা করতে অপারগতা প্রকাশ করে বললেন, ‘সার্ভার বিকল তো কী হয়েছে? আমি পেমেন্ট নিতে আপনার শাখায় এসেছি, আপনার শাখা থেকে আপনি পেমেন্ট দেবেন, আপনার সার্ভার ঠিক থাকলেই তো হলো!’ এ কথা বলেই তিনি ফোন করলেন ব্যাংকের অত্যন্ত ঊর্ধ্বতন একজন নির্বাহীকে। অভিযোগ দিয়ে বললেন, ‘আপনার অমুক শাখায় এসেছিলাম টাকা নিতে, আধা ঘণ্টা বসিয়ে রেখেছে, সার্ভার বিকল বলে পেমেন্ট দিচ্ছে না।’ ব্যাংক কর্মকর্তাকে ফোনটি ধরিয়ে দিলেন তিনি। আর অন্য প্রান্ত থেকে একটা বিশাল ঝাড়ি ভেসে এলো, ‘কী করো তোমরা? একটা চেকের পেমেন্ট দিতে এত সময় লাগে? চেক পোস্টিং দিতে না পারলে নাই, ওই ব্রাঞ্চকে (গ্রাহকের শাখা) ডেবিট করে আইবিডিএর (ইন্টার ব্রাঞ্চ ডেবিট অ্যাডভাইস) মাধ্যমে ক্লায়েন্টকে টাকা দিয়ে দাও।’ ব্যাংকার গ্রাহকের চেকটিকে স্ক্যান করে তার শাখায় ইমেইল করে সই ও ব্যালান্স নিশ্চিত হতে চাইলেন। কিন্তু জানতে পারলেন, ওই শাখার ই-মেইলও কাজ করছে না! বেচারা ব্যাংকার চেকের ইমেজ ফ্যাক্স করে টেলিফোনে গ্রাহকের সই ও ব্যালান্স নিশ্চিত হয়ে চেকটি পোস্টিং না দিয়েই পেমেন্ট দিতে বাধ্য হলেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এ গ্রাহক ভবিষ্যতে ব্যাংকের কাছে কোনো কিছু অসম্ভব মনে করবেন কি? তার কাছে ব্যাংককে সব সম্ভবের জায়গা বলেই পরিগণিত হবে। আর ব্যতিক্রম কিছু হলেই তাকে হয়রানি মনে করা হবে।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

মধ্যাহ্ন ভোজন করতে যাওয়া এক কর্মকর্তার ডেস্কের সামনে বসে এক গ্রাহক তার উষ্মা ঝাড়ছেন, ‘আমার ব্যাংকে আমাকে যেতেও হয় না, ফোন করে বললেই টাকা ছাড়াই লাখ লাখ টাকার অনলাইন পাস হয়ে যায়। আধাঘণ্টা ধরে বসে আছি, এখনও আমার ফরেন রেমিট্যান্সের পেমেন্ট নিতে পারছি না।’ ফোনের মাধ্যমে লাখ লাখ টাকার অনলাইন পাস হয়ে যাওয়া, পোস্টিং না দিয়ে চেকের পেমেন্ট দেওয়ার নাম কি সেবা? আর ব্যাংকার মধ্যাহ্ন ভোজ করতে যাওয়ায় গ্রাহকের কয়েক মিনিট অপেক্ষায় থাকাই কি অপসেবা? তাহলে আবারও সেবার মানদণ্ড এবং তার ইউনিফরমিটির কথাই ঘুরে ফিরে আসে।

ব্যাংকের সেবার মানোন্নয়নে লজিস্টিক্যাল সাপোর্টও বড় ভূমিকা পালন করে। হিসাব খুলে সাত দিন পর শাখায় এসে চেক বই গ্রহণ, বিশ দিন পর আবার এসে ডেবিট কার্ড গ্রহণ; ঋণের আবেদন গ্রহণের চার মাসের মধ্যেও ঋণ না পাওয়া লজিস্টিক্যাল ব্যর্থতাই নির্দেশ করে। ট্র্যাডিশনাল ব্যাংকিংয়ে একটি ব্যাংক লেনদেন পোস্টিং দিতে একজন ব্যাংকারই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু বর্তমানে ওয়েববেজড কোর ব্যাংকিং সিস্টেমে একটি লেনদেন সম্পন্ন হতে দুইজন ব্যাংকারকে এনগেইজড হতে হয়। কারণ একটি লেনদেনকে একজন ব্যাংকার ইনপুট বা মেক করছেন এবং আরেকজন ব্যাংকার তা অথারাইজ বা চেক করে লেনদেনটি সম্পন্ন করছেন। ফলে একই সংখ্যক লেনদেনের জন্য আগে যেখানে একটি শাখায় ১০ জন কর্মীর প্রয়োজন হতো, সেখানে বর্তমানে জনবলের প্রয়োজন দ্বিগুণ না হলেও জনবলের প্রয়োজন অবশ্যই বেড়ে যায়। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে একটি ব্যাংকের পাঁচটি শাখাও খুঁজে পাওয়া যাবে না, যাদের লোকবল বাড়ানো হয়েছে। নতুন শাখা খোলার ক্ষেত্রে পুরোনো শাখার কর্মীদের পোস্টিং দেওয়া হয় সেই নতুন শাখায়। কিন্তু লোকবলের ঘাটতিতে পড়ে যাওয়া পুরোনো শাখার লোকবল সংকট তাৎক্ষণিকভাবে আর পূরণ হয় না। ওয়েববেজড কোর ব্যাংকিং সিস্টেমে নেটওয়ার্কের মন্থর গতির কারণে সেবা কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটে। কিন্তু এর ধকল ব্যাংককর্মী ও গ্রাহক উভয়কেই পোহাতে হয়। বজ্রপাত, কুয়াশা প্রভৃতির কারণেও নেটওয়ার্কের সংযোগ সমস্যা বা গতিতে শ্লথতা চলে আসে, একটি লেনদেন সম্পন্ন হতে ক্ষেত্র বিশেষে ২০ থেকে ৩০ মিনিটও চলে যায়। একজন গ্রাহক আধা ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে যখন ক্যাশ কাউন্টারে এসে ব্যাংক কর্মকর্তার কাছে চেক প্রেজেন্ট করলেন, তখন কর্মকর্তা যদি বলে ওঠেন, ‘নেটওয়ার্ক নেই, দেরি হবে, একটু বসেন’, তখন গ্রাহকসেবা অপসেবাতেই পর্যবসিত হয়।

সেবার সঙ্গে ‘ভ্যালু অ্যাডিশন’ না করতে পারার কারণেও গ্রাহকরা অসন্তুষ্ট হয়। ধরুন, একজন গ্রাহক একটি চেকের পেমেন্ট নিতে ব্যাংকে এলেন। এই গ্রাহকের ব্যাংকের নিকট থেকে প্রত্যাশা কী হতে পারে? সাধারণ দৃষ্টিতে মনে হতে পারে, চেকে উল্লিখিত টাকা গ্রহণ করাটাই গ্রাহকের উদ্দেশ্য, আর গ্রাহককে টাকা প্রদানেই ব্যাংকের সেবাকার্য শেষ। কিন্তু আসলেই কি তা? কখনোই নয়। একজন গ্রাহক যখন একটি চেকের পেমেন্ট নিতে ব্যাংকে আসেন, তখন তিনি টাকা উত্তোলনের উদ্দেশ্যের পাশাপাশি কিছু প্রত্যাশাও সঙ্গে নিয়ে ব্যাংকে প্রবেশ করেন। ব্যাংকে প্রবেশ করেই নিরাপত্তা প্রহরীসহ ব্যাংক কর্মকর্তার সালাম পাবেন, নাতিশীতোষ্ণ নির্ঝঞ্ঝাট পরিবেশে ব্যাংকারের সব মনোযোগ নিয়ে গুরুত্বের সঙ্গে বিনা অপেক্ষায় চেকের পেমেন্ট গ্রহণ করবেন, পছন্দসই নোট গ্রহণ করবেন, অপেক্ষা করতে হলে বসার চেয়ার পাবেন, এক কাপ চা কিংবা কফিও কামনা করতে পারেন। তাই শুধু চেকের পেমেন্টের মধ্যেই ব্যাংকের সেবা কার্যক্রমের সমাপ্তি ঘটে না, গ্রাহককে সন্তুষ্ট করতে হলে গ্রাহকের বাড়তি এই প্রত্যাশাগুলোও পূরণ করতে হবে। আর বাড়তি এসব প্রত্যাশা পূরণে ব্যাংকারকে যেমন পেশাদারির সঙ্গে সেবার মানসিকতা ও মানবিকতা নিয়ে দায়িত্ব পালন করতে হবে, ঠিক তেমনিভাবে ব্যাংককেও প্রয়োজনীয় লজিস্টিক সাপোর্ট নিশ্চিত করতে হবে।

ব্যাংকগুলোয় বিপুলসংখ্যক পদ খালি থাকলেও দেওয়া হচ্ছে না নিয়োগ, বা দিলেও তা পর্যাপ্ত নয়। বেসরকারি ব্যাংকের সঠিক পরিসংখ্যান আমাদের জানা নেই। তবে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর একটা হিসাব আছে। সেটি হচ্ছে, ওই ব্যাংকগুলোয় নাকি পদ খালি রয়েছে কমপক্ষে ১৬ হাজার (সূত্র: শেয়ার বিজ, ১১ জুন, ২০১৮)। পাশাপাশি ব্যাংকিং কার্যক্রমের পরিধি তো দিন দিন বাড়ছেই। ফলে অনেক শাখায়ই প্রয়োজনীয় জনবল সংকটে সাপোর্ট স্টাফ দিয়েও অনেক ব্যাংকিং কার্যক্রম চালিয়ে নিতে হয়। আর এই লোকবলের অভাব এবং বিদ্যমান লোকবলের অদক্ষতাও গ্রাহকসেবা বিঘ্নের অন্যতম কারণ।

আমি বরাবরই গ্রাহকবান্ধব ব্যাংকিংয়ের পক্ষে ওকালতি করি। কিন্তু মাঝেমধ্যে আমিও নিজেকে প্রশ্ন করি, ‘গ্রাহক সন্তুষ্টি কি অসম্ভব কার্য?’ যদি অসম্ভবই না হবে, তাহলে ৩৬৪ দিন উত্তম সেবা দিয়েও, কোনো একদিন উনিশ-বিশ হলেই গ্রাহক কর্তৃক ব্যাংকারের বারোটা বাজাতে চাওয়াটা নিশ্চয় সন্তুষ্টি বা আনুগত্য প্রকাশ করে না। যে সম্পর্কে ভালোবাসা বিদ্যমান থাকে, সে সম্পর্কে খুব সহজে চিড় ধরে না। ব্যাংকাররা গ্রাহকদের ভালোবাসলেও গ্রাহকদের কাছ থেকে ভালোবাসা পাওয়াটা যেন অসম্ভব কাজ। মানুষ যার অভিজ্ঞতা অর্জন করে, তার ভালো-মন্দ দুটোই তার দৃষ্টিতে আসে। যা দেখেনি, শোনেনি কিংবা যার সম্পর্কে অভিজ্ঞতা নেই, তার সম্পর্কে ভালো-মন্দ মন্তব্য করা নেহাত অগ্রহণযোগ্য। আপনি যার সঙ্গে কখনো মেশেননি বা চলেননি কিংবা একসঙ্গে থাকেননি, তার ভালোটাই আপনাকে আকৃষ্ট করবে। অন্যদিকে দীর্ঘদিনের চেনা-জানার কারণে খুব কাছের মানুষটিরও নানারকম ত্রুটি-বিচ্যুতি চোখে পড়ে। আপনার ব্যাংকারদের ক্ষেত্রেও নিশ্চয়ই তার ব্যতিক্রম নয়।

তাই ৩৬৫ দিনের মধ্যে ৩৬৪ দিন সেবা এবং ভালোবাসা পেয়েও কোনো একদিনের কোনো বিশেষ অসন্তুষ্টির কারণে ব্যাংকারের সঙ্গে সম্পর্কের ব্যবচ্ছেদ ঘটানোর আগে একবার হলেও ভাববেন, ৩৬৪ দিনের প্রাপ্তির বিবেচনায় এই একদিনের অপ্রাপ্তিই কি বড়? যদিও এটাই মানুষের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য যে, আমরা কারোর ৩৬৪ দিনের উপকার মনে রাখি না, কিন্তু এক দিন উপকার চেয়ে না পেলে সেটাই মনে রাখি। গ্রাহকরাও এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, নিজের সংসারেও মাঝেমধ্যে ভুল বোঝাবুঝি বা মতের অমিল হয়ে থাকে। কিন্তু তাই বলে কি আপনি প্রথমেই ডিভোর্সের কথা ভাবেন? নিশ্চয় নয়। আলোচনা ও সমঝোতার মাধ্যেমে অনেক ভাঙনই রোধ করা যায়। আপনার ব্যাংকারকেও এমন দু-একটা সুযোগ দিন না। কোনো বিষয়ে নিজেকে আহত মনে করলে, আপনার ব্যাংকারকে একটা সুযোগ দিন; তা শুধরে নেওয়ার জন্য। হয়তো বলবেন, প্রতিযোগিতার বাজারে স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে কাউকে দ্বিতীয় সুযোগ দেওয়ার কিংবা আবেগি হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ব্যাংকে এমনও অনেক গ্রাহক আছেন, যারা নিজের ব্যবসায়িক কিছুটা ক্ষতি হলেও প্রিয় ব্যাংক ছেড়ে যান না। তাই এমন অনুগত গ্রাহকভিত্তি তৈরিতে ব্যাংকের অবশ্যই কিছু করণীয় আছে। যেমন-

০১. হিসাব বন্ধ করতে আসা গ্রাহকদের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে হিসাব বন্ধের সঠিক কারণ জানার চেষ্টা করা এবং অসন্তোষের কোনো ঈঙ্গিত পেলে তাৎক্ষণিক তা মিটিয়ে ফেলার উদ্যোগ গ্রহণ;
০২. বন্ধের যথাযথ কারণ উল্লেখপূর্বক বন্ধ হওয়া হিসাবের তালিকা মাসিক ভিত্তিতে প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো;
০৩. ছেড়ে যাওয়া গ্রাহকদের ব্যাংক ত্যাগের কারণ অনুসন্ধানপূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণ;
০৪. নিয়মিত জরিপের মাধ্যমে গ্রাহকের সন্তুষ্টি পরিমাপ করা;
০৫. বর্তমানে লেনদেন সময় শেষ হয় বিকাল চারটায়। কিন্তু ব্যবসায়ীরা (বিশেষ করে চলতি ঋণগ্রহীতা গ্রাহকগণ) যারা রাতের ৮ টা-১০টা পর্যন্ত বেচাবিক্রি করেন, তারা চান দিনের শেষে ক্যাশ বাক্সের সব টাকাই ব্যাংকে জমা দিয়ে ঝুঁকিমুক্ত থাকতে এবং ঋণের সুদ কমাতে। কিন্তু চারটায় লেনদেন সময় শেষ হওয়ার কারণে এই সুবিধা তারা পান না। তাই ব্যাংকিংয়ের বিকল্প ডেলিভারি চ্যানেল, যেমন- কিয়স্ক বা এটিএম বুথের মাধ্যমে চারটার পরেও টাকা জমা বা উত্তোলনের ব্যবস্থা রাখা;
০৬. লেনদেনের সর্বশেষ সময় বিকাল চারটা পর্যন্ত নির্ধারিত থাকার কারণে অনেক ব্যবসায়ী গ্রাহক, বিশেষ করে সিসি হাইপো ঋণগ্রহীতা গ্রাহকরা একেবারে কাঁটায় কাঁটায় চারটা বা তার পরেই ব্যাংকে আসতে অভ্যস্ত। ফলে যেসব গ্রাহক কাঁটায় কাঁটায় চারটায় কিংবা চারটার পরে ব্যাংকে প্রবেশ করে, তাদের লেনদেন নিশ্চয়ই বিকাল চারটার মধ্যে সম্পন্ন করা সম্ভব হয় না। এর ফলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককর্মীর সেবা মানসিকতায় লেনদেন পরবর্তী সময়ে সেবা দিতে গিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়। তাই লেনদেনের সময়ের মতো লেনদেনের উদ্দেশ্যে ব্যাংকে প্রবেশের সময়ও নির্ধারণ করে দেওয়া উচিত;
০৭. ক্যাশলেস ব্যাংক ব্যবস্থার সম্প্রসারণে ইন্টারনেট ব্যাংকিংকে গ্রাহকের জন্য সহজলভ্য ও নিরাপদ করে তোলা এবং মোবাইল ব্যাংক অ্যাকাউন্টগুলোর সঙ্গে ব্যাংক অ্যাকাউন্টের অর্থ আদান-প্রদানের ব্যবস্থা করা;
০৮. বিভিন্ন ব্যাংকিং নিয়মাচার, সুদহার ও সুদের প্রদান/আদায় পদ্ধতি, বিভিন্ন চার্জ (অ্যাকাউন্ট মেইনটেন্যান্স চার্জ, আয়কর, আবগারি শুল্ক প্রভৃতি) সম্পর্কে গ্রাহকদের অবগত করতে এবং গ্রাহক সচেতনতা বৃদ্ধিতে ব্যাংকের নিজস্ব ওয়েবসাইট, ফ্যানপেইজ, মোবাইল অ্যাপ, প্রিন্ট ও টেলিমিডিয়ার মাধ্যমে প্রচার বাড়ানো;
০৯. এসএমএস অ্যালার্টের মাধ্যমে গ্রাহকের হিসাব হতে যে কোনো কর্তন এবং আমানত এবং ঋণের সুদ হারের পরিবর্তন সম্পর্কে গ্রাহককে তাৎক্ষণিক অবগতকরণ;
১০. গৃহীত সেবার সব নিয়ম ও শর্ত সম্পর্কে গ্রাহককে পুরোপুরি অবগতকরণ;
১১. গ্রাহকের অভিযোগ রেকর্ডকরণ এবং সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে নিষ্পত্তিকরণ;
১২. সব ব্যাংকিং সেবা এবং পণ্য সম্পর্কে ব্যাংকারকে স্বচ্ছ ধারণা রাখতে হবে। তাই ব্যাংকারদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে;
১৩. গ্রাহকদের ব্যতিক্রমধর্মী প্রয়োজনগুলো সমাধানের কিংবা পূরণের সহজ পদ্ধতি অবলম্বন করা, যেমন- চেক বই বা এফডিআর হারিয়ে গেলে করণীয় কী, মৃত ব্যক্তির হিসাবের অর্থ উত্তোলনের পদ্ধতি, কীভাবে ব্যাংক ম্যানেজার বরাবর বিভিন্ন আবেদন করতে হয় প্রভৃতির নিয়ম এবং নমুনা ব্যাংকের ওয়েবসাইটে প্রদর্শন এবং প্রয়োজনে এসব বিষয়গুলো ব্যাংকার নিজে সম্পাদন করে দেওয়া;
১৪. ছোট, ছেঁড়াফাটা নোট গ্রহণ এবং বিনিময়ে পদ্ধতি সহজীকরণ;
১৫. ব্যাংকারদের দক্ষতা উন্নয়নের পাশাপাশি নিরবচ্ছিন্ন ও দ্রুতগতির ইন্টারনেট ব্যবস্থার মাধ্যমে সেবাদানে দ্রুততা নিশ্চিতকরণ;
১৬. অপেক্ষমাণ গ্রাহকের বসা ও আপ্যায়নের ব্যবস্থা করা;
১৭. উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে আর্থিক লেনদেনে নিরাপত্তা এবং শতভাগ স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা;
১৮. গ্রাহকের ফোন, মেইল, চিঠি বা জিজ্ঞাসাগুলোর ত্বরিত উত্তর দেওয়া;
১৯. ব্যাংকারদের সার্ভিস প্লাস নীতি অনুসরণ করে গ্রাহকদের আস্থা অর্জনের পাশাপাশি গ্রাহকদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ, জানাশোনা বাড়িয়ে ঋদ্ধতাপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করতে হবে এবং তা বজায় রাখতে হবে। এজন্য ব্যাংকারকে সততা ও পেশাদারির সঙ্গে সেবাদানের পাশাপাশি গ্রাহকের শুভাকাক্সক্ষী, সহমর্মী, উপদেষ্টার ভূমিকাও পালন করতে হবে;
২০. বিদ্যমান গ্রাহকদের সৎ ছেলে আর নতুন গ্রাহকদের আপন ছেলে হিসেবে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি বদল করে উভয়কেই সমান গুরুত্বারোপ করতে হবে;
২১. শাখা ও প্রধান কার্যালয়ে কাস্টমার ইন্টারেস্ট প্রটেকশন ইউনিট গঠন;
২২. পরামর্শ ও অভিযোগ প্রদানে গ্রাহকদের উৎসাহিত করা এবং অভিযোগ/পরামর্শ প্রদান পদ্ধতি সহজীকরণ;
২৩. ব্যাংকারদের জবাবদিহির মধ্যে আনা এবং দোষী ব্যাংককর্মীদের শাস্তির আওতায় আনা;
২৪. সেবার মানদণ্ড নির্ধারণ, যেমন পাঁচ মিনিটের মধ্যে একটি চেকের পেমেন্ট প্রদান, আধা ঘণ্টার মধ্যে একটি হিসাব খোলা, ১৫ দিনের মধ্যে ঋণ প্রদান প্রভৃতি;
২৫. গ্রাহকদের কমপেন্সেট করা, যেমন- নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ঋণ দিতে না পারলে সুদের হার কমিয়ে দেওয়া। কাউকে ১০ মিনিটের বেশি লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হলে অতিরিক্ত মিনিটগুলোর জন্য নির্ধারিত হারে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেওয়া, যেমন- অতিরিক্ত প্রতি ১০ মিনিট অপেক্ষার জন্য গ্রাহকের হিসাবে ৫০ টাকা জমাপ্রদান;
২৬. প্রতিটি শাখার গ্রাহকসংখ্যা, লেনদেনের ভলিউম প্রভৃতি বিবেচনায় জনবল নিশ্চিত করা এবং কর্মীদের উপযুক্ত মূল্যায়ন ও প্রণোদনা নিশ্চিত করা। (শেষ)

লেখকঃ মোশারফ হোসেন, ব্যাংক কর্মকর্তা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button